মো কামরুল হোসেন সুমন, স্টাফ রিপোর্টার: ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে উপকূলজুড়ে মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ১৩ অক্টোবর শনিবার মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের জন্য নিষিদ্ধ হচ্ছে ইলিশ ধরা । যা অব্যাহত থাকবে আগামী ২ নভেম্বর পযন্ত ।
এ সময় সকল মাছ ধরা,পরিবহন,বিপণন ও সংরক্ষণ সম্পন্ন নিষিদ্ধ থাকবে । এতে বেকার হয়ে পড়বে ভোলার মনপুরা উপজেলার মেঘনার পাড়ের কয়েক শত জেলে। যে কারণে অভাব-অনটন আর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বেন তারা। এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধে তাদের কপালে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাজ। তবে নিষেধাজ্ঞার সময়ে তালিকাভুক্ত প্রত্যেক জেলেকে ২৫ কেজি করে ভিজিএফ এর চাল দেওয়া হবে।এবং নিষেধাজ্ঞা এ সময় জেলেদের ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাংক ও এনজিও গুলোকে ঠিঠি দেওয়া হয়েছে ।
জেলেরা বলছেন, এবার ভরা মৌসুমে মনপুরা সংলগ্ন মেঘনা নদীতে ইলিশ কম থাকায় অনেকেই দেনার দায়ে জর্জরিত। এরই মধ্যে আবার ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলে আশায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
জানা যায়, প্রজনন মৌসুম হিসেবে মা ইলিশ রক্ষায় টানা ২২ দিন সারা দেশে সব ধরনের মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। এ সময়ে মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ।মাছ ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখতে গত কয়েক দিন ধরেই মাছঘাটগুলোতে সচেতনতামূলক মাইকিং ও ঘাটে ঘাটে ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
জেলে ও মৎস্যজীবীদের নিয়ে করা হয়েছে সভা ও সেমিনার। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞাকালীন জেলেদের ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাংক ও এনজিওগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
এদিকে নদীতে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে মনপুরার জেলেরা আড়তদারের দাদন ও এনজিওর ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার জেলেদের জন্য ২৫ কেজি চাল বরাদ্দ দিলেও সব জেলে এ চাল পায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।যেসব জেলে সরকারি বরাদ্দের চাল পায়, তারাও এক সপ্তাহের বেশি এ চাল দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। ফলে অভিযানের সময় ঋণের বোঝা আরো ভারি হয় জেলেদের।
মনপুরার বিভিন্ন মাছ ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, ২২ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ থাকবে আর তাই ঘাটে ভেড়ানো হচ্ছে নৌকা-ট্রলার। কেউ কেউ আবার শেষবারের মতো মাছ ধরতে নদীতে যাচ্ছেন। তবে তাদের ফিরতে হবে আজ রাত ১২টার আগেই। কেউ কেউ আবার আগে থেকেই জাল, নৌকাসহ মাছ ধরার সব উপকরণ তুলে এনেছেন ঘাটে।
সরকারের নিষেধাজ্ঞা মানতে প্রস্তুত থাকলেও পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে দিন কাটাবেন সে চিন্তার ছাপ রয়েছে জেলেদের চোখে-মুখে। সংকট দূর করতে নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলে পুনর্বাসনের চাল দ্রুত বিতরণের দাবি জেলেদের।
মনপুরা উপজেলা দক্ষিণ সাকুচিয়ার জেলে মো.মিজান মাঝি জানান,নদীতে নামার সময় এনজিও থেকে ১ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে নৌকা নদীতে নামাতে হয়েছে । এ বছর নদীতে তেমন মাছের দেখা মেলেনি। ১৫-২০ দিন আগ থেকে কিছু মাছ ধরা পড়তেছে। তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যা দিয়ে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। নয় সদস্যের পরিবারের খরচ যোগিয়ে সপ্তাহে তিন হাজার টাকা এনজিওর কিস্তি দিতে হয়। এতে করে অনেকটা টানাপড়েনের মধ্যেই দিন যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকার ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষা অভিযান দিয়েছে। এই ২২ দিনে নতুন করে আরো দেনা করতে হবে। সরকার যে চাল দেয় তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৫-৬ দিন চলে। তবে বর্তমানে দ্রব্যমূল্যর যে দাম এত করে চাল দিয়ে কি সংসার চালালো যাবে ?
জানা গেছে, মনপুরা নিবন্ধিত জেলে ১৪ হাজার ৩ শত ৪৭ জন থাকলেও চাল বরাদ্দ হয়েছে ১১ হাজার ৫০ জন জেলের নামে। নিবন্ধিত হয়েও অনেকের ভাগ্যে জুটবে না পুনর্বাসনের চাল। আর তাই অনেক জেলেকেই কাটাতে হবে অনেকটা ধার-দেনা করে।পেশায় জেলে হলেও অনেকে নিবন্ধিত হতে পারিনি এমন জেলে সংখ্যা রয়েছে অনেক ।তাদের অভিযোগ জেলে নিবন্ধনের সময় ৫০০ শত টাকা করে নেওয়া তাদের কাছে টাকা না থাকায় তারা নিবন্ধিত তালিকায় আসতে পারিনি।
জনতা ঘাটের সমুদ্রগামী জেলে মজিদ মাঝি জানান, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাগরে মাছ শিকার করে স্ত্রী ছেলে-সন্তান নিয়ে তিন বেলা খেয়ে কোনোমতে দিন চলে। আগের বঙ্গোবসাগরে অনেক মাছ ধরা পড়তো । গত ২ বছর সমুদ্রে তেমন মাছ নেই । তাই পুরো বছর ঋণের বোঝা টানতে হয় তাদের। সাগরে যে মাছ পাওয়া যায় তা বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন। উল্টো বর্তমানে প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে বছরে তিন-চারবার সাগরে অভিযান থাকে। অন্য সময়েও তেমন মাছ ধরা পড়ে না। তাই জেলেদের পুরো বছর ধরেই ঋণের বোঝা টানতে হয়। এর মধ্যে আবার সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় নতুন করে আবার ধারদেনা করতে হয়। তা ছাড়া জেলে পেশা ছাড়া আর কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে সাগরে মাছ শিকার করেই জীবিকা চলে তার। একসময় নিজের ট্রলার থাকলেও ধারদেনা করতে করতে এখন অন্যের ট্রলারে থেকে মাছ শিকার করতে হয়।
মনপুরা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৃজন সরকার জানান, শনিবার মধ্যরাত থেকে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম হিসেবে আগামী ২২ দিন মনপুরা মেঘনা নদীতে মা-ইলিশ রক্ষা অভিযান চলবে। এ অভিযান সফল করতে ও জেলেদের সচেতন রাখতে বিভিন্ন ঘাটে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে।আমরা ২২ দিনের মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা অভিযান কঠোর করার জন্য সব প্রস্ততি গ্রহন করেছি । যারা সরকারি আইন অমান্য করে নদীতে গিয়ে মাছ শিকার করবে তাদের জেল ও জরিমানা করা হবে ।